প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। প্রতিটি এলাকা থেকে গৃহহীনদের খুঁজে খুঁজে বের করে ঘর করে দেয়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় কক্সবাজারে খুরুশকুলে বিশ্বের সর্ববৃহৎ জলবায়ু উদ্বাস্তু আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় নির্মিত ফ্ল্যাট হস্তান্তর অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে যুক্ত হয়ে তিনি এ কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ হবে ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত। সেই স্বপ্ন পূরণে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। জতির পিতার জন্মশতবার্ষিকীতে আমাদের লক্ষ্য বাংলাদেশের একটি মানুষও গৃহহীন থাকবে না। প্রত্যেকটি মানুষকে যেভাবে পারি ঘর করে দেব।
তিনি বলেন, কক্সবাজার আমাদের পর্যটক এলাকা। এখানকার সৈকতে বিশাল ঝাউবন জাতির পিতার নির্দেশেই করা হয়েছিল- যেন প্রাকৃতিক জলোচ্ছ্বাস থেকে কক্সবাজার শহর রক্ষা করা যায়। জাতির পিতার সেই স্বপ্ন কক্সবাজারটাকে আরও সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে চাই পর্যটন শহর হিসেবে।
শেখ হাসিনা বলেন, আমাদের সমুদ্রসৈকতটা বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্রসৈকত। এত সুন্দর বালুকাময় সমুদ্রসৈকত পৃথিবীর আর কোনো দেশে নেই। এত চমৎকার একটা জিনিস সেটা দেশের মানুষ এবং বিশ্বব্যাপী সবাই যেন উপভোগ করতে পারে সে লক্ষ্য নিয়ে এই অঞ্চলের উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নিই। বিমানবন্দরটাকে এমনভাবে উন্নত করতে চাই যেখানে হয়তো সারাবিশ্ব থেকে অনেকে আসতে পারবে। যত বড় বিশাল বিমান হোক নামতে পারবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমানবন্দর নির্মাণ করতে গিয়ে দেখলাম জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এবং ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কারণে অনেকে ঘরবাড়ি, ভিটামাটি হারিয়ে উদ্বাস্তু হয়ে আছেন। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম তাদের পুনর্বাসন করব। সেই চিন্তা থেকেই এ প্রকল্প। এখন ২০টি ভবন করা হয়েছে, ভবিষ্যতে বাকি ভবন করা হবে।
এখানে সবকিছু থাকবে। ১৪টা খেলার মাঠ, সবুজ এলাকা থাকবে, মসজিদ, মন্দির থাকবে। অন্য ধর্মালম্বী যদি থাকে তাদের প্রার্থনার জায়গাও থাকবে। স্কুল থাকবে, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্কুল করে দেব। পুকুর খনন করা হয়েছে। সেখান থেকে সুপেয় পানি খেতে পারবেন।
বৃষ্টির পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। পুলিশ ফাঁড়ি করা হবে। ফায়ার স্টেশন থাকবে। দুটো জেটি করা হবে যেখানে জাহাজ ভাঙতে পারবে। তাছাড়া যারা মাছ ধরতে যান, তারা যেন শুঁটকি শুকাতে পারেন সেজন্য শুঁটকি শুকানোর জায়গা করে দেব, সুন্দর বাজার করে দেব। সুন্দর শুঁটকির হাট করে দেব। সেটা দৃষ্টিনন্দন আধুনিকভাবে করে দেব যেন মানুষ দেখতে যায়।
এখানে স্যোলার প্যানেলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বিদ্যুতের জন্য সাবস্টেশন করা হবে। বর্জ্য ব্যবস্থা করতে হবে। তাছাড়া বাকখালী নদীর ওপর ব্রিজ নির্মাণ কাজ শুরু হয়ে গেছে, সেখানে ৫৯৫ দৈর্ঘ্যরে একটা প্লেস নির্মাণ করা হচ্ছে। সেখানে ৪টি সাইক্লোন শেল্টার করা হবে। যে ভবনগুলো নির্মাণ করা হয়েছে সেগুলোর নিচতলা সম্পূর্ণ ফাঁকা অর্থাৎ জলোচ্ছ্বাস হলে পানি যেন এদিক থেকে ওদিকে চলে যেতে পারে।
সরকারপ্রধান বলেন, কক্সবাজারে বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। শুধু এখানে নয়, দেশের কোথায় গৃহহীন, ভূমিহীন মানুষ আছে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নিচ্ছি। আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে যেমন ঘর করে দিচ্ছি, পাশাপাশি যাদের জমি আছে তাদের ঘর করে দেয়ার জন্য গৃহায়ন তহবিল নামে বাংলাদেশ ব্যাংকে একটা তহবিল করা আছে। সেখান থেকে যে কোনো প্রতিষ্ঠান প্রকল্প গ্রহণ করতে পারে।
খুরুশকুলে আলাদা একটা সুন্দর শহর গড়ে উঠবে উল্লেখ করে ফ্ল্যাট পাওয়া পরিবারগুলোর উদ্দেশে তিনি বলেন, আপনারা এতদিন যেভাবে ছিলেন কষ্টের মধ্যে আমি নিজে গিয়েছি, দেখেছি সেটা, এখন আপনারা সুন্দরভাবে বসবাস করতে পারবেন। আপনাদের ছেলেমেয়েরাও বড় হবে, মানুষ হবে সেটাই আমরা চাই।
সেদিকে লক্ষ্য রেখেই ব্যবস্থা নিয়েছি। আজকে যেই ঘরবাড়িগুলো করে দেয়া হল, মনে রাখবেন এটা আপনাদের নিজেরই। সেভাবে যত্ন নিয়ে ব্যবহার করবেন। সুন্দরভাবে যাতে থাকে সেদিকে দেখবেন। আর এখানে নদীর কূল ধরে সবুজ বেষ্টনী করে দেয়া হবে। কোনোরকম ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে যেন ক্ষতিগ্রস্ত না হয় এবং আপনারাও ব্যাপকভাবে বৃক্ষরোপণ করবেন। পুকুর কেটে দেয়া হয়েছে। আর তাছাড়া জীবন-জীবিকার সুযোগ আমরা সৃষ্টি করে দেব। সেভাবেই সবাইকে পুনর্বাসন করতে চাই।
বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি রয়েছে : বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রস্তুতি সরকারের রয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, এবার বন্যার প্রকোপটা বেশি দেখা যাচ্ছে। তবে আমাদের প্রস্তুতি আছে, এটা মোকাবেলা করার। বন্যায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত বা নদীভাঙনে যারা গৃহহারা হচ্ছেন তাদেরও আমরা ঘরবাড়ি করে দেব। বাজেটে আমরা আলাদাভাবে টাকাই রেখে দিয়েছি গৃহহীন মানুষদের ঘর করে দেয়ার জন্য।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদেরও উদ্বাস্তু হিসেবে থাকতে হয়েছিল। কাজেই রিফিউজি হিসেবে থাকার যন্ত্রণাটা আমাদের জানা আছে। তিনি বলেন, আমাদের কাজের গতি খুব ভালো ছিল। কিন্তু এই করোনাভাইরাস এসে সব জায়গাতেই একটা বাধার সৃষ্টি করেছে।’
খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় মোট ৪৪৪৮টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসন করা হবে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে প্রাথমিকভাবে ৬০০ পরিবারের কাছে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে অত্যাধুনিক ফ্ল্যাট হস্তান্তর করেন। জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবার পুনর্বাসন বিশ্বে এটিই প্রথম।
খুরুশকুল দেখতে যাব, শুঁটকিভর্তা দিয়ে ভাত খাব : উদ্বোধন শেষে প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সে উপকারভোগীদের সঙ্গে কথা বলেন। বস্তির ঝুপড়ি ঘরে কষ্টের জীবন শেষে দালানে উঠতে পেরে আবেগাফ্লুত হয়ে পড়েন অনেকে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে অনেকেই কেঁদে ফেলেন। আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান তারা। এ সময় জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে বড় আশ্রয়কেন্দ্র আশ্রয়ণ প্রকল্প সরাসরি দেখতে যাওয়ার ইচ্ছার কথা জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খুরুশকুল দেখতে যাব। শুঁটকিভর্তা দিয়ে ভাত খাব।’
অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস। এ সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিব মো. তোফাজ্জল হোসেন মিয়াসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
খুরুশকুলের অনুষ্ঠানস্থলে উপস্থিত ছিলেন চকরিয়া-পেকুয়া আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম, মহেশখালী-কুতুবদিয়া আসনের আশেক উল্লাহ রফিক, সদর-রামু আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল, উখিয়া-টেকনাফ আসনের সংসদ সদস্য শাহীন আকতার, মহিলা সংসদ সদস্য কানিজ ফাতেমা আহমদ, খুরুশকুল আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) মাহবুব হোসেন, চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমশিনার এবিএম আজাদ, সেনাবাহিনীর দশম পদাতিক ডিভিশনের জিওসি এবং এরিয়া কমান্ডার মো. মাঈন উল্লাহ চৌধুরী, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক কামাল হোসেন, পুলিশ সুপার এবিএম মাসুদ হোসেন, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোস্তাক আহমদ চৌধুরী, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সিরাজুল মোস্তফা, সাধারণ সম্পাদক ও পৌর মেয়র মুজিবুর রহমান।
সংশ্লিষ্টরা জানান, খুরুশকুলে বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে ২৫৩.৫৯ একর জমিতে ১৮০০.৩৯ কোটি টাকা ব্যয়ে ৫ তলাবিশিষ্ট ১৩৯টি ভবন নির্মাণ করার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে বিশ্বে এক অনন্য নজির স্থাপন করছেন। প্রকল্পের প্রথম ধাপে ২০টি বহুতল ভবনের নির্মাণ কাজ শেষ হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, ২০১৫ সালে প্রকল্পের ভরাটের কাজ শুরু হয়। প্রকল্পে চারতলাবিশিষ্ট ২৪৫টি ভবন নির্মাণ করার কথা রয়েছে। প্রতিটি ভবনে রয়েছে ৩২টি করে ইউনিট। নির্মিত এসব ভবনে আশ্রয় পাবে ৬৪০টি পরিবার।
এই বৃহৎ আশ্রয় প্রকল্পে রয়েছে স্কুল, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ সার্বিক সুযোগ-সুবিধা। পাশাপাশি পর্যায়ক্রমে কলেজসহ আরও প্রয়োজনীয় নানা প্রতিষ্ঠান। নির্মিত ২০টি অত্যাধুনিক ভবনের নামকরণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজেই।
নামগুলো হচ্ছে- সাম্পান, কোরাল, রজনীগন্ধা, গন্ধরাজ, হাসনাহেনা, কামিনী, গুলমোহর, গোলাপ, সোনালী, নীলাম্বরী, ঝিনুক, কেওড়া, মুক্তা, প্রবাল, সোপান, মনখালী, শনখালী, দোলনচাঁপা, ইনানী ও বাঁকখালী।
Posted ২:২০ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২৪ জুলাই ২০২০
protidinerkushtia.com | editor