‘পানি খালি ঘুরবের নাইগছে বাহে। দক্ষিণের পানি উত্তরে আর পুবের পানি পশ্চিমে। ব্রহ্মপুত্র, তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার, গঙ্গাধর, হলহলিয়া পানি উগলে দিছে বাহে। এলা ডিস্ট্রিক্ট বোর্ডের সড়ক উছলিয়ে অফিস-আদালতত ঢুকপের নাইগছে পানি।
’কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রাম জেলার চিলমারীর রমনা এলাকার বাসিন্দা আলম সরকার (৫২)। তাঁর এলাকা একবার প্লাবিত পানি সহজে নামে না। ফসল নষ্ট হয়ে যায়। চিলমারীর ব্রহ্মপুত্রের খোর্দ বাঁশপাতা চরের কৃষক বাদশা মিয়া (৫০) বলেন, তাঁর বাড়িতে এবার পানি ওঠেনি, তবে চর ভাঙছে। একই কথা বললেন চিলমারী ইউনিয়নের শাখাহাতী চরের শিক্ষক মাঈদুল ইসলাম (৩৮)।
গিরাই, মর্নেয়া, ছোট তোরসা, নাগেশ্বরসহ সাত-আটটি নদ–নদীর উপজেলা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী। কিন্তু দুধকুমার ছাড়া আর কোনো নদ–নদীর অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। সেগুলোকে বড় বড় দিঘি বানিয়ে লিজ দেওয়া হয়েছে। নাগেশ্বরীর দুধকুমার নদের বাসিন্দা মামুনুর রশিদ (৩০) বলেন, দুই বছর ধরে দুধকুমার নদের পাড় ভাঙছে; কয়েকটা গ্রাম দুই দিনেই নদগর্ভে বিলীন হয়েছে।
নদ খনন হয়েছে কি না জানতে চাইলে বলেন, সব নামকাওয়াস্তে হয়েছে। চিলমারী রমনা স্টেশনসংলগ্ন বেতখাওয়ার বিল, পেদী খাওয়ার বিল, হরিশ্বের ডেরা বৃষ্টির পানিতে থইথই। জেলা সড়ক উপচে পানি ঘরবাড়ির ছাদ ছুঁই ছুঁই। বিলগুলোর পানি আসা-যাওয়ার কালভার্টগুলোর মুখ বন্ধ করে বাড়িঘর ও মার্কেট গড়ে উঠেছে। এমনকি মোটরশ্রমিকের বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। উলিপুর-চিলমারীতে ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা ধরে পূর্ব-দক্ষিণ থেকে পশ্চিমব্যাপী উপবৃত্তাকার পাউবো বাঁধ।
দক্ষিণে তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের সংগমে পাত্রখাতা গ্রাম। এখানে মানাস, মাইলডাঙ্গা নদীসহ কয়েকটি নদী মিলেছে। এখানে আধা সচল একটি মাত্র স্লুইসগেট। উলিপুর-চিলমারীর সব পানি এখানে এসে আটকে গেছে। বাঁধ ভাঙার উপক্রম। পানিবন্দী বিস্তীর্ণ এলাকার অধিবাসীরা বাঁধ কেটে দেওয়ার দাবি তুলেছেন।
বাংলাদেশে বন্যার ধরন ও পরিবর্তন নিয়ে স্কটল্যান্ডের ডান্ডি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক নন্দন মুখার্জি বলেছেন, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তা অববাহিকায় প্রায় ৫০০টি বাঁধ, ব্যারাজ ও জলবিদ্যুৎকেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে। সেগুলো পানির স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করছে। প্রায় সব অবকাঠামোই চীন, ভারত ও নেপালে।
সেই দেশগুলোতে বন্যা ১০ দিনের বেশি স্থায়ী হচ্ছে না। কিন্তু বাংলাদেশে তিন সপ্তাহ ধরে চলছে। আরও ১০ থেকে ১৫ দিন চলবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে সরকারের বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণকেন্দ্র। কেন?
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায় তাঁর আত্মচরিত-এ ১৯২২ সালে উত্তরবঙ্গে ব্রহ্মপুত্রের বন্যা সম্পর্কে বলেছেন, ‘প্রজাদের আবেদন গ্রাহ্য করিয়া যদি রেলওয়ের সংকীর্ণ কালভার্টগুলো বড় সেতুতে পরিণত করা যাইত, তবে এই বন্যা নিবারণ করা যাইত।…সম্প্রতি প্রসিদ্ধ জলশক্তি বিশেষজ্ঞ ইঞ্জিনিয়ার স্যার উইলিয়াম উইলকক্স যেসব বক্তৃতা করিয়াছেন, তাহার দ্বারা বাঁধ নির্মাণ করিবার অসারতা প্রমাণিত হইয়াছে।’ ১৯২২ সালের বন্যা নিয়ে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান পত্রিকার এক প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল, বন্যার জন্য দায়ী নদী নয়, অতিবৃষ্টি নয়, দায়ী ব্রিটিশের তৈরি রেলপথ। স্থপতি ড. বেল্টলিকের মন্তব্য ছিল এ রকম, যেসব প্রকৌশলী ওই অঞ্চলে জেলা বোর্ড ও রেলওয়ের রাস্তাগুলো নির্মাণ করেছেন, তাঁরা এ দেশের স্বাভাবিক পানিনিষ্কাশনের পথগুলোর কথা ভাবেননি। বন্যার কারণ বাংলার নদ–নদীগুলোর স্বাভাবিক পানিপ্রবাহ বিঘ্নিত করে রেলপথগুলো।
১৯০৭ সালে ইন্ডিয়ান মিরর পত্রিকায় লেখা হয়, রেললাইন বাঁচাতে গিয়ে দামোদরের পূর্বপাড় বরাবর বাঁধ নির্মাণের পর বর্ধমান ও হুগলি জেলার জলাভূমিগুলো পুনরুজ্জীবিত হয়নি। ১৯১৭ সালে তৈরি করা হয় হাওড়া-বর্ধমান কর্ড লাইন। এভাবে ১৯ শতকের মধ্যভাগ থেকে নদ–নদীর পাড়ে বাঁধ নির্মাণের ফলে শাখা নদ–নদীগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ফল ১৯৪৩ সালে দামোদরের ভয়াবহ বন্যা, যার তোড়ে দামোদরের বাঁধ, জিটি রোড ও রেললাইন ভেঙে গিয়ে কলকাতা উত্তর ভারত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। শাখা নদ–নদীগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে বালুতে ঢেকে ও মজে মৃতপ্রায় হয়ে যায়।
দ্য চেঞ্জিং ফেস অব বেঙ্গল ও স্টাডি অব রিভারাইন ইকোনমি নামের দুই গ্রন্থের বিখ্যাত লেখক রাধা কমল মুখার্জি ১৯৩৮ সালে বলেন, সকলের অলক্ষ্যেই বদলে যাচ্ছে নদীমাতৃক বাঙলার চিত্র। এখন শীতের শেষে সব নদী শুকিয়ে যায়। দামোদর, কাঁসাই, অজয় বা ময়ূরাক্ষীকে দেখলে মনে হয় মরুভূমি। এপ্রিল মাসে বালির মধ্য দিয়ে বয়ে চলা ক্ষীণ ধারাও হারিয়ে যায়। একই চেহারা উত্তরবঙ্গের করতোয়া, আত্রাই, পুনর্ভবাসহ অনেক নদীর। কুড়িগ্রামে ৫০টি আর রংপুরে দেড় শতাধিক নদ–নদী উধাও করে দিয়ে বন্যার কী কী কারণ আমরা খুঁজছি?
নাহিদ হাসান রেল-নৌ যোগাযোগ ও পরিবেশ উন্নয়ন গণকমিটির কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের সাবেক সভাপতি
Posted ১:৫০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০
protidinerkushtia.com | editor