ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে করোনা ডেডিকেটেড ২৫০ শয্যার কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা পরিস্থিতি। এক-দেড় ঘণ্টা ব্যবধানে ঘটছে একেকটি মৃত্যু। একইসঙ্গে ছটফট করছেন অসংখ্য করোনা আক্রান্ত মানুষ। চিকিৎসকরা বলছেন, এটি একটি নিরুপায় পরিস্থিতি, তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।
প্রতিদিনের কুষ্টিয়ার সংবাদদাতা আজ বুধবার হাসপাতালের পুরো পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি এ বিষয়ে কথা বলেছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে।
হাসপাতাল সূত্র জানায়, সেখানে গত ২৪ ঘণ্টায় করোনায় মারা গেছেন ১৩ জন। এ ছাড়া, উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন আরও তিন জন।
হাসপাতাল সূত্র বলছে, বুধবার সকাল পর্যন্ত সেখানে ২৫২ জন করোনা আক্রান্ত রোগী চিকিৎসাধীন।
এত বিশাল সংখ্যক রোগীকে চিকিৎসা দেওয়ার মতো সামর্থ্য হাসপাতালের নেই বলে জানান হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার তাপস কুমার সরকার।
তিনি জানান, অসংখ্য রোগীকে তারা সাপোর্ট দিতে পারছেন না। রোগীদের যে ধরনের চিকিৎসা দরকার তার ব্যবস্থা এখানে নেই। তার দেওয়া হিসেবে, ২৫২ জন রোগীর মধ্যে অধিকাংশেরই অক্সিজেন প্রয়োজন হচ্ছে। এর মধ্যে, প্রায় শতাধিক আক্রান্তের অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৪৫ থেকে ৭০ ভাগ।
তাপস কুমার সরকার বলেন, ‘হাসপাতালে একটি সি-প্যাপ, একটি বি-প্যাপ, চারটি আইসিইউ ও ২৪টি এইচডিইউ বেড আছে। এই ২৪টি শয্যায় মূলত জটিল রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া হয়, যেখানে হাই-ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলাসহ অন্যান্য আধুনিক উপকরণ ব্যবহার করা হয়। বাইরে অন্য রোগীদের সাধারণ বেডে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা অথবা সিলিন্ডারে অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। সেন্ট্রাল অক্সিজেন সরবরাহ আছে ৬৪টি বেডে। উচ্চমাত্রার (হাই-ফ্লো) অক্সিজেন দেওয়া সম্ভব ২২ জনকে।’
‘যাদের স্যাচুরেশন ৪৫ থেকে ৭০ ভাগ, এমন সবাইকেই উচ্চমাত্রার অক্সিজেন দেওয়া দরকার, কিন্তু সম্ভব হচ্ছে না। তাদেরকে হয় সেন্ট্রাল অক্সিজেন সেবা অথবা সিলিন্ডারের অক্সিজেন দিয়ে চিকিৎসা করা হচ্ছে’, বলেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতিদিন প্রায় ৫০০ অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রয়োজন হচ্ছে। হাসপাতালে আছে ৬৪৭টি সিলিন্ডার। এ ছাড়া, ছয় হাজার লিটারের সেন্ট্রাল অক্সিজেন রয়েছে। সেটা দিয়ে ১০ জনকে ২৪ ঘণ্টা অক্সিজেন সাপোর্ট দেওয়া হয়।’
হাসপাতালে দায়িত্বরত অনেক চিকিৎসকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কঠিন পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে তারা হিমশিম খাচ্ছেন।
কুষ্টিয়া মেডিকেল কলেজের সহকারী অধ্যাপক আকরামুজ্জমান মিন্টু বলেন, ‘গত সাত-আট দিন ধরে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট নিয়ে রোগীরা আসছেন। আবার তারা নিজ বাড়িতে ৭-৮দিন আইসোলেশনে থাকার পর আসছেন, যখন অবস্থা সাংঘাতিক হয়ে যায় তখন। শেষ সময়ে হাসপাতালে আনা হয় তাদের। ততক্ষণে চিকিৎসকদের কিছুই করার থাকে না। বেশিরভাগ রোগীর অক্সিজেন লেভেল আশির নিচে চলে যায়।’
তিনি জানান, এসব রোগীদের মধ্যে মৃত্যুহার বেশি। এ ছাড়া, এসব রোগীদের অধিকাংশ ডায়াবেটিস, হার্টের সমস্যা, অ্যাজমা, হাইপারটেনশন, ব্লাড প্রেশার ও লিভারের রোগে আক্রান্ত। হাজারো চেষ্টা করেও তাদের বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব হচ্ছে না।
করোনা ইউনিটে কাজ করছেন চিকিৎসক রাজীব মৈত্র। তিনি বলেন, ‘প্রায় একশর বেশি রোগী আছেন, যাদের স্যাচুরেশন ৬০ ভাগের নিচে। তাদের উচ্চ মাত্রায় অক্সিজেন দেওয়া দরকার। কিন্তু সামর্থ্য নেই।’
দেওয়ান রাশিদুজ্জামান তার স্ত্রীকে হাসপাতালে ভর্তি করেন গত রোববার। তিনি কোনো বেড পাননি। হাসপাতালের করিডোরে ঠাঁই নিয়েছেন। সার্বক্ষণিক স্ত্রীর পাশে আছেন। তার স্ত্রী উল্কা খাতুনের স্যাচুরেশন ৮০, অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। তার ডায়াবেটিস আছে।
রাশিদুজ্জামান জানান, আক্রান্ত হওয়ার পর দৌলতপুর স্বাস্থ্যকেন্দ্র থেকে তার স্ত্রীকে হোম আইসোলেশনে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়। হোম আইসোলেশনে অবস্থা বেগতিক দেখে তিনি তাকে সরাসরি এই হাসপাতালে আনেন।
তিনি জানান, এখন ডাক্তার বলছে রোগীর অবস্থা খারাপ।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রোগীর ভিড়ে হাসপাতালের কোথাও পা ফেলার জায়গা নেই। গাদাগাদি অবস্থা। খোদ হাসপাতালের মধ্যেই বিন্দুমাত্র সামাজিক দূরত্ব নেই। রোগীর স্বজনরা বসে বা শুয়ে আছেন রোগীর পাশেই।
আছে জনবল ও জায়গার অভাব সংকট। চিকিৎসক, নার্স, আয়াসহ সংশ্লিষ্ট সবাই সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন।
হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক আবদুল মোমেন প্রতিদিনের কুষ্টিয়াকে বলেন, ‘রোগীর চাপ বাড়ছেই। প্রতিদিন প্রায় ৪০-৫০ নতুন রোগী ভর্তি হচ্ছেন। করোনামুক্ত হচ্ছেন তার অর্ধেকেরও কম। যার কারণে রোগী ডাম্পিং হয়ে যাচ্ছে।’
তিনি জানান, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও কিছু চিকিৎসা যন্ত্রপাতি দিয়েছে। সেগুলো অন দ্য ওয়ে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচ এম আনোয়ারুল ইসলাম জানান, তার জেলা ভালো নেই। খুলনা বিভাগে কুষ্টিয়ার অবস্থান উদ্বেগজনক। সব উপজেলায় বাড়ছে মৃত্যু ও শনাক্তের সংখ্যা।
তিনি বলেন, ‘কুষ্টিয়া জেনারেল হাসপাতালের সীমিত সামর্থ্যের মধ্যেই ডাক্তাররা যুদ্ধ করে চলেছেন।’