ইসলামের মূলমন্ত্র হল তাওহীদ বা একত্মবাদ। আর এই একত্মবাদ শিক্ষার একমাত্র মাধ্যম রিসালাত।
তাই আবদ এবং রবের মধ্যে কোনো মাধ্যম ইসলাম যেমন সমর্থন করে না,তেমনি স্থূল ও জড় কোনো বস্তুকে আল্লাহতায়ালার আসনে বসিয়ে পূজা-অর্চনা করাও ইসলাম অনুমতি দেয় না।
চিন্তা-মনোযোগ এবং প্রেম-অনুরাগ এক আল্লাহ ভিন্ন অন্য কোথাও কেন্দ্রীভূত করা ইসলাম এক মুহূর্তের জন্যও মেনে নেয় না।
আবার পোপ-পুরোহিত বা আল্লাহর আশির্বাদপ্রাপ্ত কোনো ব্যক্তি, বস্তু বা স্থানের ধারণা ইসলাম সমর্থন করে না। কোনো মাধ্যম ছাড়াই একজন বান্দা আল্লাহর সঙ্গে সরাসরি সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে।
আল্লাহ্ তায়ালা ইরশাদ করেন, ‘আর যখন আমার বান্দা আমার সম্পর্কে আপনার কাছে জিজ্ঞেস করে,তখন (আপনি বলে দিন) আমি তো নিকটেই আছি। আমি বান্দার ডাকে সাড়া দিই যখন আমাকে তারা ডাকে। তাদেরও উচিত আমার বিধান মেনে নেয়া এবং আমার উপর ঈমান আনা। নিঃসন্দেহে তারা সৎপথ প্রাপ্ত হবে। (সূরা বাকারা:১৮৬)
কিন্ত মানুষের ফিতরাত ও স্বভাব এমন কিছুর সন্ধান করে থাকে যাকে দেখে এবং যার সান্নিধ্যে এসে আখিরাতে আল্লাহর সঙ্গে মিলনের স্বাদ কিছুটা হলেও আস্বাদন করতে পারবে।
তাই মহান আল্লাহ্ বান্দাদের জন্য কিছু স্থূল ও জড় বস্তু নির্দিষ্ট করে দিয়েছেন যা সেই মহান সত্তার পবিত্রতায় মহিমান্বিত। এগুলোর সঙ্গে এমন কিছু ঘটনা জড়িয়ে রয়েছে যা মানুষকে তাওহীদের শিক্ষা দেয়।
এগুলোকেই শাআইরুল্লাহ্ বলা হয়। যারা শা’আইরুল্লাহর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে তারা আল্লাহর প্রতিই সম্মান প্রদর্শন করে থাকে।
আল্লাহ্ বলেন, যারা শা’আইরুল্লাহর প্রতি সম্মান,শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করবে তা তাদের হৃদয়ের পবিত্রতারই নিদর্শন। (সূরা হজ :৩২)
আর বায়তুল আতিক বা বায়তুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্কিত নিদর্শনসমূহ শা’আইরুল্লাহর অন্তর্ভুক্ত।
ইমাম গাযালি র. ইহইয়াউ উলূমিদ্দীন গ্রন্থে লিখেছেন, যেহেতু পবিত্র কাবার সম্পর্ক হল আল্লাহর মহান যাতের সঙ্গে। তাই এটা স্বাভাবিক যে,প্রত্যেক মুসলমান হবে কা’বা পাগল। বায়তুল্লাহর জিয়ারতে ধন্য হবে। যদি এ জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে কোনো পুরস্কার ও উত্তম প্রতিদানের ঘোষণা না হতো তবুও।
ইমাম শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবি র. তার অনবদ্য হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ গ্রন্থে বলেন, মাঝে মধ্যে মানুষ তার রবের প্রেমে মাতোয়ারা ও উদ্বেলিত হয়ে উঠে। তখন সে তার আবেগ,উচ্ছ্বাস শান্ত ও তৃপ্ত করার অবলম্বন খোঁজে। অবশেষে সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয় যে, হজই হচ্ছে একমাত্র উপায় এবং বায়তুল্লাহর জিয়ারতই হচ্ছে সেই অবলম্বন।
পৃথিবীর প্রতিটি ধর্ম ও সম্প্রদায়ের কিছু পবিত্র বা তীর্থ স্থান রয়েছে। বিশেষ ধর্মীয় উপলক্ষকে কেন্দ্র করে ভক্ত অনুসারীরা সে সব পবিত্র স্থানের দর্শন লাভের উদ্দেশে তীর্থ যাত্রায় বের হয়।
মহান আল্লাহ্ বলেন, প্রতিটি উম্মাহর জন্যই আমি কুরবানির ব্যবস্থা করেছিলাম যেন তারা আল্লাহর নাম নিতে পারে সব প্রাণীর ওপর, আল্লাহ্ যা তাদের রিজিকরূপে দান করেছেন। তবে তোমাদের প্রভূ কিন্তু এক,অভিন্ন। সুতরাং তারই সামনে তোমরা নত হও। আর যারা মস্তক অবনত করে, আপনি তাদের সুসংবাদ দান করুন। (সূরা হজ:৩৪)
মূলত পৃথিবীর কোনো জাতি, ধর্ম ও সম্প্রদায় তীর্থ যাত্রার ইতিহাস থেকে বঞ্চিত নয়। সভ্যতার এ এক গৌরবময় ইতিহাস। প্রযুক্তির চরম উৎকর্ষের যুগে ও যার ধারবাহিকতা রয়েছে।
ইহুদি ধর্মের তীর্থযাত্রা
বর্তমান বিশ্বে ইহুদি জাতি জ্ঞান-বিজ্ঞান সভ্যতা-সংস্কৃতি, সম্পদ প্রাচুর্যে আগ্রগামী। সুদূর প্রাচীনকাল হতে আজ পর্যন্ত বায়তুল মুকাদ্দাস তাদের তীর্যযাত্রা এবং উপাসনার শ্রেষ্ঠতম স্থান হিসেবে গণ্য করা হয়।
ইহুদি ধর্মের অন্যতম উৎসগ্রন্থ Jewish Encyclopedia-এ উল্লেখ করা হয়েছে- ক. Harvest Festival খ. Easter ও গ. Feast of Tabernacle এই তিনটি উৎসব উপলক্ষে বায়তুল মুকাদ্দাসে তীর্থযাত্রা অনুষ্ঠিত হতো।
শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক নারী ছাড়া সবার জন্য উপস্থিতি বাধ্যতামূলক ছিল। প্রত্যেক তীর্থ যাত্রীকেই কিছু একটা উৎসর্গ করার বিধান ছিল।
নির্দিষ্ট তারিখে তীর্থ উপাসনা অনুষ্ঠিত হতো। সে দিবসগুলোর নাম ছিল,তীর্থ দিবস। এই দিবসগুলোতে নবী,বাদশা কিংবা দরবেশদের মাজার জিয়ারত করার প্রথা চালু হয়।
সাধারণত শ্যামুয়েল নবী এবং ‘হায়কলে সুলায়মানি’ জিয়ারত করা হতো। এ ছাড়া প্রতিটি অঞ্চলেও ইহুদিদের তীর্থক্ষেত্র ছিলো যেখানে তারা উৎসব পালন করত।
বুখতে নসর কর্তৃক Temple ধ্বংসের পরও তীর্থ যাত্রার ধারা অব্যাহত ছিল। সালাহ উদ্দীন আইউবীর নেতৃত্বে ১১৮৭ খৃস্টাব্দে বায়তুল মুকাদ্দাস বিজয়ের পর ইহুদিদের জন্য বায়তুল মুকাদ্দাস, দামেস্ক এবং ইরাকের বিভিন্ন পবিত্রস্থানে যাত্রার দ্বার উম্মোচিত হয়।
ক্রুসেড যুদ্ধের সময় ইউরোপীয় ইহুদিরাও বায়তুল মুকাদ্দাস জিয়ারতের আগ্রহী হয়। ১৪৯২ খৃস্টাব্দে স্পেন থেকে ইহুদিরা বহিষ্কৃত হয়ে তুরস্ক এসে বসবাস শুরু করলে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে।
খ্রিস্টান ধর্মের তীর্যযাত্রা
খ্রিস্ট ধর্ম একটি জীবন্ত ও প্রাণবন্ত ধর্ম পৃথিবীময় যাদের তাহযীব,তামাদ্দুন এবং আধিপত্য জলে স্থলে ও অন্তরীক্ষে বিস্তৃত।
Encyclopedia of Religion and Ethics নামক বিশ্বকোষে খ্রিস্ট ধর্মের তীর্থ উপসনা সম্পর্কে বলা হয়েছে, প্রভূ যীশুর পার্থিব জীবনের স্মৃতিবিজড়িত ফিলিস্তিনের বিভিন্ন অঞ্চল কিংবা রোমাতে বিদ্যমান ধর্ম নেতাদের আস্তানাসমূহ কিংবা ঈশ্বরের প্রিয় পুরুষ ও শহীদদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র স্থানসমূহ জিয়ারত করাই হলো তীর্যযাত্রা।
খ্রিস্টান তীর্থ যাত্রীদের কাছে বায়তুল মুকাদ্দাসের পরই ছিলো রোমার স্থান। সেন্ট পিটার ও সেন্ট পলের সমাধি এবং পোপবাদের বিস্তারের কারণে রোমান ক্যাথলিকদের নিকট রোমা পবিত্র স্থান হিসেবে ধর্মীয় মর্যাদা লাভ করে।
শহীদদের দেহাবশেষ থাকার কারণে Catacost খ্রিস্ট দর্শনার্থীদের নিকট ধর্মীয় মর্যাদা লাভ করে।
মোট কথা ফিলিস্তিন ও খ্রিস্টান অধ্যুষিত অঞ্চলে আরো অনেক গির্জা, আস্তানা এবং সমাধির কারণে খ্রিস্টান জাতির অসংখ্য তীর্থক্ষেত্র ও পবিত্র স্থান ছিলো।
পবিত্র স্থান ও কবরের প্রতি অন্ধ প্রেম ও মাত্রাতিরিক্ত ভক্তির কারণেই ইহুদি ও খ্রিস্টান জাতি দুটি অবশেষে শিরিকে লিপ্ত হয়।
হিন্দু ধর্মের তীর্যযাত্রা
হিন্দুদের তীর্যক্ষেত্র ও পবিত্র স্থানের অধিকাংশই গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত। যেমন এলাহাবাদের গঙ্গা-যমুনার সংযোগস্থল, উত্তর প্রদেশের বারানসি শহরের গঙ্গাস্নান, কাশির গঙ্গাস্নান ইত্যাদি।
কাশীতে মৃত্যুবরণ করার জন্য অনেকেই শেষ বয়সে এখানে বসবাস শুরু করে। শ্রী কৃষ্ণের জন্মভূমি মথুরা,রামের কর্মস্থল অযোধ্যা এবং হিমালয়ের পাদদেশের হরিদ্বারও হিন্দুদের নিকট পবিত্র ও জনপ্রিয় তীর্থক্ষেত্র।
বৌদ্ধ ধর্মের তীর্থযাত্রা
বৌদ্ধ ধর্মের তীর্থযাত্রা হলো গঙ্গা। এ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা শ্রী গৌতম বুদ্ধ বিহার প্রদেশের গোয়াতে ‘নির্বাণ’ লাভ করেছিলেন। তাই গোয়াও তাদের পবিত্রতম স্থান। এ সকল স্থানে সারা বছর মেলা,পার্বণ ও উৎসব হয়ে থাকে। এসব মেলা,উৎসব ও স্নানের দিনগুলোতে যৌন অপরাধসহ নানাবিধ সমাজিক অপরাধ সংগঠিত হয়ে থাকে।
ইমাম শাহ্ ওয়ালিউল্লাহ হুজ্জাতুল্লাহিল বালিগাহ গ্রন্থে বলেন, হজ্জের মূল উপাদান পৃথিবীর সকল জাতির মধ্যেই বিদ্যমান রয়েছে।
ইবরাহীম আ. এর স্মৃতি ও সুন্নাহ
রাসূল সা. বলেন, তোমরা হজ্জের স্থানসমূহে অবস্থান করো। কেননা এটা তোমাদের পিতার উত্তরাধিকার সম্পদ। সাইয়্যিদুনা ইবরাহীম আ. ও সাইয়্যিদুনা ইসমাইল আ. মিল্লাতে হানিফার ইমাম।
সুতরাং মিল্লাতের ইমাম থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত দশটি সুন্নত এবং হজ্জের বিধি-বিধান যথাযথ হেফাজত করা আমাদের কর্তব্য।
জাহেলিয়াতের বিকৃতি থেকে মোহাম্মাদি সংস্করণ
জাহেলি যুগে কুরায়শরা গোত্রীয় অহংকারের কারণে অন্যান্য হাজীর সঙ্গে আরাফাতে না গিয়ে মক্কায় অবস্থান করতো। ইসলাম এই জাহেলি আচরণ ও গোত্রীয় অহংবোধকে প্রত্যাখান করে নির্দেশ জারি করলো,কুরায়শগণ অন্যান হাজীদের সাথে আরাফা ময়দানে গমণ করবে।
আল্লাহ্ বলেন, অত:পর তোমরা সেখানে গিয়ে প্রত্যাবর্তন করো যেখানে গিয়ে অন্য লোকেরা প্রত্যাবর্তন করে। (সূরা বাকারা:১৯৯)
জাহেলি যুগে হজ্জকে কেন্দ্র করে ‘উকায’, ‘যুল-মিজান্নাহ’ এবং যুল-মাজাযের মতো মেলা বসতো। যেখানে কবিরা একত্র হয়ে স্ব স্ব গোত্রের বীরত্ব ও প্রতিপক্ষ গোত্রের নামে কুৎসামূলক কবিতা আবৃতি করতো।
তাদের এই ঘৃণ্য কাজকে বন্ধ করে আল্লাহ্ আমলে নিয়োজিত হবার নির্দেশ প্রদান করলেন- যখন তোমরা হজ্জের সকল কাজ পূর্ণ করো তখন আল্লাহকে স্মরণ করো স্বীয় পূর্বপুরুষদের স্মরণ করার মতো কিংবা আরো উত্তমরূপে। (সূরা বাকারা:২০)
জাহেলি যুগে হজ্জের মধ্যে অশ্লীল কার্যকলাপ, খেল-তামাসা ছড়িয়ে পড়েছিল। মহান আল্লাহ্ তা’লা এ ধরণের কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করেন।
ইরশাদ করেন, হজ্জ অবস্থায় কোন প্রকার অশ্লীল কথা,অশ্লীল আচরণ ও ঝগড়া-বিবাদ বৈধ নয়। ( সূরা বাকারা:১৯৭)
জাহেলিয়াত যুগের মুশরিকগণ দেবদেবী ও উপাস্যের নামে পশু বলি দিত এবং গোশত দেবদেবীদের সামনে রেখে গায়ে রক্ত ছিটিয়ে দিত।
এ ধরণের কার্যকলাপ অবৈধ আখ্যা দিয়ে আল্লাহ্ ঘোষণা দেন, আল্লাহর কাছে কোরবানিকৃত পশুর গোশত কিংবা রক্ত কিছুই পৌঁছাবে না। হ্যাঁ তাঁর কাছে তোমাদের তাকওয়া বা খোদাভীরুতা পৌঁছে। (সূরা হজ্জ:৩৭)
ইসলাম পূর্ব যুগে মুশরিকরা সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় বায়তুল্লাহর তাওয়াফ করতো।আল্লাহ্ নির্দেশ দান করেন, হে বণী আদম! প্রতি নামাজের সময় তোমরা পোশাক পরিধান করে নাও। (সূরা আরাফ: ৩১)
সাফা-মারওয়ার পাদদেশে সাঈ’ করাকে অনেকে জাহেলিয়াত ভেবে ছেড়ে দিতো।
তখন আল্লাহ্ আয়াত অবতীর্ণ করেন, নিঃসন্দেহে সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনসমূহের অন্যতম। অতএব যে ব্যক্তি হজ্জ কিংবা উমরা করবে তার পক্ষে এটা পাপ নয় যে,সে উভয়ের মাঝে দৌঁড়াবে। (সূরা বাকারাঃ১৫৮)
লেখক: শিক্ষক, মনিপুর উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ, মিরপুর, ঢাকা
Posted ১:২৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৩ জুলাই ২০২০
protidinerkushtia.com | editor