১৩ দিন ধরে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে এক্সরে মেশিন। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে এক্সরে করতে আসা রোগীরা। এদিকে হাসপাতালের দেয়া তথ্যের সাথে কোন মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি রোগীর বেডেও। মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের করোনা ওয়ার্ডে ৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন থাকলেও রয়েছে মাত্র একজন। সেও আবার ঐ হাসপাতালেরই আয়া।
রোগী ও রোগীর স্বজনদের অভিযোগ রয়েছে, হাসপাতালে এক্সরে করতে আসা রোগীদের হাসপাতালের মেশিনে ভালো হবে না বলে বাইরের দুটি ক্লিনিকে পাঠানো হয়। সেখানে ৫ গুণ বেশি টাকা দিতে হয় রোগীদের। এছাড়া হাসপাতালের দায়িত্বরত চিকিৎসকরা হাসপাতালে না চিকিৎসা দিয়ে বাইরের প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়মিত রোগী দেখার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সরোজমিনে মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ঘুরে আরো বেশকিছু চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। সেইসাথে সত্যতা পাওয়া গেছে রোগী ও স্বজনদের অনেক অভিযোগেরও।
সাড়ে তিন লাখ মানুষের চিকিৎসা কেন্দ্র মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। অথচ সরকারি এই হাসপাতালের করুণ দশা। অপরদিকে এই উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের কোটি টাকা মূল্যের নতুন এক্সরে মেশিন অর্ধযুগ ধরে প্যাকেটজাত অবস্থায় স্টোররুমের জায়গা দখল করে পড়ে আছে। দীর্ঘদিনেও মেশিনটি জনস্বার্থে ব্যবহার করা হয়নি।
বৃহস্পতিবার (১৩ আগস্ট) মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দেয়া তথ্যমতে, ৫০ শয্যাবিশিষ্ট উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকের ২১টি পদের মধ্যে পদায়ন রয়েছে ১০ জন। এছাড়া সাব সেন্টারে ১২ জন চিকিৎসক রয়েছেন। হাসপাতালের মোট ২২১ পদের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মধ্যে পদায়ন রয়েছে ১৬৮ জন।
করোনার কারণে চিকিৎসকদের সরকারি একটি বাসভবনে করোনা ওয়ার্ড চালু করা হয়েছে। সেখানে ৮ জন চিকিৎসাধীন রয়েছেন। এদের মধ্যে ৪ জন পুরুষ এবং ৪ জন নারী। তারা সকলেই ওই হাসপাতালের কর্মকর্তা/কর্মচারী। এছাড়া করোনা ভাইরাসের নমুনা নিয়ে হাসপাতালের আইসোলেশন ওয়ার্ডে রয়েছে আরো একজন পুরুষ রোগী। সাধারণ রোগীসহ মোট চিকিৎসাধীন রয়েছেন ২৬ জন। এদের মধ্যে ১৪ জন পুরুষ এবং ১২ জন নারী। করোনার কারণে আলাদা করোনা ওয়ার্ডে হাসপাতালের সকল চিকিৎসকই শিফট ভাগে দায়িত্ব পালন করেন।
তবে বাস্তবে সাধারণ রোগীদের তথ্যের মিল পাওয়া গেলেও করোনা রোগীর তথ্যের কোন সত্যতা পাওয়া যায়নি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, হাসপাতালের ৪ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়ে করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসা নিচ্ছেন। তারা হলেন- ডা. সৈয়দা তাসনীমা তাবাসুম, ডা. এসএম সাজ্জাদুল ইসলাম, ডা. মামুনুর রশিদ, ডা. শেখ আব্দুল্লাহ আল মুকিত। এবং এক্সরে ম্যান শরিফ হাসান, নার্স খোরশেদা পারভীন, আকলিমা খাতুন এবং আয়া সানোয়ারা খাতুন।
করোনা ওয়ার্ডে গিয়ে দেখা যায়, বারান্দায় এক নারী কোন প্রকার সুরক্ষা না নিয়েই গ্রিলের সামনে আরো দুই নারীর সাথে কথা বলছেন। তবে তাদের কারো মুখেই মাস্ক নেই। দেখে বোঝার উপায় নেই এটা হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ড। নেই কোন রোগী। নেই আলাদা চিকিৎসক।
ওই নারী বলেন, কাউকে খুঁজছেন নাকি? নাকি করোনা পরীক্ষা করাবেন। ডাক্তার তো এখানে নেই। সাদ আলী ক্লিনিকে রাকিব স্যার (ডা. যুবায়ের ইবনে রাকিব) বসে, ওখানে যান।
ওই নারীর পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমিই করোনা রোগী। আমার নাম সানোয়ারা খাতুন। এই হাসপাতালে আয়া হিসাবে চাকরি করি। আমি গত ৭ জুলাই থেকে এই করোনা ওয়ার্ডে একাই চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালের হিসাব মতে, ৮ জন করোনা ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন থাকলেও সরোজমিনে দেখা মেলে শুধু সানোয়ারা খাতুনকেই।
সানোয়ারা খাতুন বলেন, আমি ছাড়া আর কোন রোগী নেই। গত ৭ তারিখ থেকে তো আমি একাই।
হাসপাতালের এক্সরে ম্যান শরিফ হাসান গত ২ আগস্ট থেকে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় লোকবলের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে রয়েছে একমাত্র সচল এক্সরে মেশিন। আর নতুন ডিজিটাল এক্সরে মেশিনটি জনবলের অভাবে ২০১৪ সাল থেকে প্যকেট খোলাই হয়নি। এদিকে ভোগান্তিতে পড়ছে দিনে প্রায় শতাধিক এক্সরে করতে আসা রোগী ও স্বজনরা।
একাধিক রোগীর অভিযোগ, মিরপুর হাসপাতালের এক্সরে করা হচ্ছে না। এক্সরে ম্যানের করোনা হয়েছে। তাই ৭০ টাকার এক্সরে করতে খরচ হচ্ছে ৩৫০-৪০০ টাকা। এছাড়া হাসপাতালে এক্সরে করলেও আবার প্রাইভেট ক্লিনিকে পাঠায়।
মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনেই সাদ আলী ও জয়মন ক্লিনিকে এক্সরে করা হয়। সেখানে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে দুটি ক্লিনিকে ৬০-৭০ জন এক্সরে করেন সেখানে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাসপাতালের এক চিকিৎসক জানান, হাসপাতালের ৪ জন করোনা চিকিৎসক করোনা আক্রান্ত দেখিয়ে সেই চিকিৎসকরা বাড়িতে থাকছে। আবার প্রাইভেট ক্লিনিকে রোগী দেখছে। করোনা ওয়ার্ডে রোগী শুধুমাত্র ভর্তিই আছে, কিন্তু থাকে শুধু আয়া।
মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. জেসমিন আরা জানান, ২০১৪ সালে যারা দায়িত্বে এসেছেন তারাও দেখেছে এই ডিজিটাল এক্সরে মেশিন প্যাকেটে। এখনো লোকবলের অভাবে পড়ে রয়েছে। আর গত ২ আগস্ট থেকে এক্সরে ম্যান শরিফ হাসান করোনা পজেটিভ, তাই বন্ধ রয়েছে সচল এক্সরে মেশিনটিও। এতে রোগীদের একটু ভোগান্তি হচ্ছে।
তিনি আরো জানান, হাসপাতালের কয়েকজন ডাক্তার এবং স্টাফ স্বপরিবারে করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। আমরা তাদের হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি নিয়েছি। তাদের সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে। তবে তারা করোনা ওয়ার্ডের পরিবর্তে বাড়িতে থাকেন। ভর্তি না নিলে তো ওষুধসহ সেবা দিতে পারবো না।
তিনি আরো বলেন, করোনা আক্রান্ত ৮ জনই এই মিরপুর হাসপাতালের ডাক্তার ও কর্মচারী। তাই তাদের একটু সুবিধা দেয়া হচ্ছে।
কুষ্টিয়ার সিভিল সার্জন ডা. এইচএম আনোয়ারুল ইসলাম জানান, করোনা পজেটিভ রোগীকে কোনমতেই সাধারণ রোগীর মতো দেখা ঠিক না। করোনা রোগী হাসপাতালের করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি, কিন্তু বাইরে রয়েছে এমন তথ্য আমার কাছে এসেছে। আমি মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নির্দেশনা দিয়েছি যাতে করোনা ওয়ার্ডে ভর্তি রোগীগুলো হাসপাতালে থেকেই চিকিৎসা গ্রহণ করে।
মিরপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি ও কুষ্টিয়া-২ (মিরপুর-ভেড়ামারা) আসনের সংসদ সদস্য হাসানুল হক ইনু বলেন,এক্সরে টেকনিশিয়ান করোনায় আক্রান্ত হওয়ার কারণে বর্তমানে বন্ধ রয়েছে এক্সরে কার্যক্রম। আশা করছি খুব দ্রুতই তিনি সুস্থ হলে আবারো এক্সরে হবে। আর নতুন এক্সরে মেশিনটির টেকনিশিয়ান না আসা পর্যন্ত সেটি চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। সূত্র বাংলাদেশ জার্নাল।
Posted ১২:০৬ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৭ আগস্ট ২০২০
protidinerkushtia.com | editor